নিজস্ব প্রতিবেদক: হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে, অচেনা পরিবেশে কঠোর শ্রমের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় উপার্জন করে পরিবারকে ভাল রাখতে গিয়ে, যেনো নিজের খেয়াল রাখাই ভুলে যাচ্ছেন প্রবাসী কর্মীরা। এতে তাদের শরীরে বাসা বাঁধছে হৃদরোগ, বিকল হচ্ছে কিডনি, বাড়ছে স্ট্রোকের ঝুঁকি। এই অযত্নের খেসারত দিতে হচ্ছে জীবন দিয়ে। তিন দশকে বিভিন্ন দেশে অর্ধ লক্ষ প্রবাসী কর্মীর মৃত্যু অন্তত সেই কথারই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, দৈনিক প্রতি ২ ঘন্টায় গড়ে একজন প্রবাসীর মরদেহ দেশে আসছে।
নবাবগঞ্জের নিভৃত এক গ্রামের নাম বাইল্যা। গাঁয়ের এক কোনে এক কুড়েঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করা এক পিতা, তার সন্তানের মাধ্যমে দেখেছিলেন পরিবারের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন। একারণে ছোট ছেলে আমজাদ হোসেনকে পাঠিয়েছিলেন সৌদি আরবে।
তবে কুঁড়েঘরে শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দেখাই বুঝি যমদূত হয়ে দাঁড়িয়েছিল সৌদি প্রবাসী আমজাদ হোসেনের জীবনে। বিদেশে যাবার সাতমাসের মাথায় মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যু বরণ করা প্রবাসী আমজাদের নিথর দেহ ফিরে আসে বাংলাদেশে। হতবিহব্বল পরিবারটিতে এখন শুধুই হাহাকার।
আমজাদের বড়ভাই বলেন, প্রথমে আমরা খোঁজ পাই যে আমার ভাই মারা গেছে। তখনও জানতে বা বুঝতে পারিনি যে আমার ভাইকে কেউ মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু পরে অন্য এক লোকের মাধ্যমে ছবিতে দেখতে পেরেছি যে তাকে ফাঁসি দিয়ে মারা হয়েছে।
উন্নত জীবনের আশায় বিপুল অর্থ খরচ করে ভীনদেশে পড়ি জমিয়ে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরানোর বহু গল্পের আড়ালে রয়েছে এমন হাজারো করুন ঘটনা। যার সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৮ নম্বর ফটক।
মধ্যরাতে বিমানবন্দরের আকাশে যখন বাসন্তি চাঁদের হাসি, মাটিতে অপেক্ষমান এই মানুষ গুলোর জীবনে তখন আমাবস্যার অন্ধকার। তাদেরই একজন লক্ষীপুরের সেলিম মিয়া।
শুনেছেন, এক দশকের বেশী সময় সৌদি আরবে কর্মরত সন্তান ফারুকের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে। বিমানবন্দরে সন্তানের মরদেহ গ্রহণ করতে এসে পিতার অস্থীর মনকে শান্তনা দিতেই যেনো তার এই দিগ্বীদিক ছোটাছুটি।
তিনি বলেন, আমার সন্তান বিদেশেই মারা গেছেন। কিন্তু কেন কিভাবে মারা গিয়েছে তা আমরা কেউই বলতে পারছি না।
কথায় বলে রাত যত গভীর হয় প্রভাত আসে তত নিকটে। কিন্তু বিমানবন্দরের এই আঙ্গিনায় রাতের গভীরতা বাড়লে, বাড়ে মরদেহের সারি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা কারণে মৃত্যুবরণ করা প্রবাস কর্মীদের মরদেহ হস্তান্তর চলে পুরোটা রাত জুড়ে। তেমনি এক গল্প সৌদি প্রবাসী মোজাম্মেল হেসেনের। মাত্র ২১ বছর বয়সে যিনি জীবনের মুক্তি খুঁজেছেন আত্মহত্যার মাধ্যমে। তবে মৃত্যুর কারণ হিসেব আত্মহত্যাকে কোনো ভাবেই মানতে পারছেন না মোজাম্মেলের পরিবার।
শুধু আমজাদ, ফারুক কিংবা মোজাম্মেল নয়, গেলো দেড় যুগে দেশের ৩ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪৫ হাজার ৩০১ জন প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। এর মধ্যে ২৭ হাজার ২৩১ জনের মরদেহ এসেছে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে। যা মোট মৃত্যুর ৬৩ শতাংশ। এরমধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকেই এসেছে ১২ হাজার ৯৩০ জন প্রবাসীর মরদেহ।
এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৫ হাজার ১২৩ জন, ওমান থেকে ৩ হাজার ৭৭৬ জন, কুয়েত থেকে ২ হাজার ৭২৪ জন, বাহরাইন থেকে ১ হাজার ১১ জন এবং কাতার থেকে এসেছে ১ হাজার ৫৬২ জন প্রবাসী কর্মীর মরদেহ।
তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত একযুগে ৩৬ হাজার তিনজনের মরদেহ দেশে এসছে। এছাড়া এর আগের এক দশকে ৯ হাজার ৩০১ জন প্রবাসীর মরদেহ মিলে, ১৯৯৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন দশকে ৪৭ হাজার ৮০২ জন প্রবাসী কর্মীর মরদেহ আসার তথ্য আছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে।
প্রবাসীদের মরদেহের সঙ্গে যে নথিপত্র আসে সে অনুযায়ী অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, হৃদরোগ ও আত্মহত্যা। আশংকা জনকভাবে এতো বিপুল সংখ্যক প্রবাসী কর্মীরা কেন স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে? প্রশ্ন ছিল হৃদরোগ গবেষক ও চিকিৎসকের কাছে।
মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চয়ন সিংহ বলেন, আমাদের দেশে যেসব প্রবাসীর মরদেহ আসছে তাতে আমরা স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্তের নমুনা পেয়ে থাকি।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, আমাদের দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার আগে কিছু প্রবাসীরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। কিন্তু বিদেশে গিয়ে তারা আর তাদের শরিরের দিকে খেয়াল রাখেন না। বা বিদেশ থেকে দেশে ফিরেও তারা আর শরিরের দিকে খেয়াল না রাখায় বিপদ হচ্ছে।
এদিকে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রচণ্ড গরম, তেলযুক্ত খাবার, ভয়াবহ পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা, মালিকের অত্যাচার, স্বজনদের বিভিন্ন চাহিদা, বিনোদনহীন একঘেয়ে জীবনযাপন প্রবাসী কর্মীদের মারাত্নক মানসিক চাপে ফেলছে। এছাড়া উচ্চ অভিবাসন খরচের ব্যয়ের চাপ কর্মীদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান বলেন, যেসব কাজে অনেক ঝুঁকি রয়েছে সেসব কাজে বাংলাদেশ দেশে বেশি শ্রকিক যাচ্ছে। এইসব বিষয়ে যদি পরিবর্তন করে আগামীতে দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠাতি পারি। আমরা ১০ লাখ বিদেশে না পাঠিয়ে দক্ষ এক লাখ পাঠালে সেই এক লাখেই ১০ লাখের সমান রেমিটেন্স যেন নিয়ে আসতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে পারে। পাশাপাশি যেন তারাও একটা সম্মানের জায়গায় কাজ করতে পারে।
তবে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রবাসী কর্মীদের জন্য যে ডাটাবেইজ তৈরীর যে কাজ চলছে সেটি শেষ হলে কর্মীদের কর্মস্থল, পরিবেশ, কাজের ধরনসহ আনুষাঙ্গিক সব তথ্য মিলবে। যা নিরাপদ অভিবাসনে পালন করবে সহায়ক ভূমিকা।
এছাড়া এই সংকট সমাধানে মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছে অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থাগুলো। একইসঙ্গে, বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন নিশ্চিত করার চেষ্টা, এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি বলেও মত তাদের।